, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫ , ১৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
হরমুজ প্রণালিতে তিন জাহাজে আগুন

​ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা ছড়াল সমুদ্রে

  • আপলোড সময় : ১৮-০৬-২০২৫ ০৩:৫৭:৩২ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১৮-০৬-২০২৫ ০৩:৫৭:৩২ অপরাহ্ন
​ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা ছড়াল সমুদ্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া জাহাজে আগুন লাগার ছবি। ছবি- এক্স

১৭ জুন মঙ্গলবার, আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক নৌরুট হরমুজ প্রণালীর কাছাকাছি ওমান উপসাগরে অন্তত তিনটি জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক সূত্র। এসব জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণ এখনও পরিষ্কার নয়, তবে ঘটনাটি ঘটেছে ইরান-ইসরায়েল সামরিক উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, যার ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল ও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে।

ঘটনাস্থল ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের খোর ফাক্কান উপকূল থেকে প্রায় ২২ নটিক্যাল মাইল দূরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বেশ কিছু ছবিতে সমুদ্র থেকে বিশাল অগ্নিশিখা ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেছে। যদিও ছবিগুলোর সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি, তবুও অনেক ব্যবহারকারী দাবি করেছেন যে, এসব আগুনে জর্জরিত জাহাজগুলো মূলত তেলবাহী ট্যাংকার এবং এগুলো ইরানের জলসীমার কাছেই অবস্থান করছিল।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সামুদ্রিক নিরাপত্তা সংস্থা অ্যামব্রে (Ambrey) জানায়, তারা ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত এবং এটি কোনো নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যু বা চলমান আঞ্চলিক সংঘাতের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয় বলে মনে করছে। যদিও ঠিক কী কারণে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে তা নিয়ে সংস্থাটি কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়নি।

নাসা’র ফায়ার ইনফরমেশন ফর রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (FIRMS) স্যাটেলাইট ডেটা বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, ঘটনাস্থলে তিনটি সক্রিয় অগ্নিকেন্দ্রের অস্তিত্ব শনাক্ত করা গেছে। আগের কোনো দিনে এই অঞ্চলগুলোতে এমন অগ্নিচিহ্ন দেখা যায়নি, যা এই দাবিকে শক্তিশালী করছে যে ঘটনাটি সদ্যই ঘটেছে এবং এটি একটি বড় ধরনের সামুদ্রিক ঘটনা হতে পারে।

হরমুজ প্রণালীর কাছে তিন জাহাজে আগুনের গুজব – দ্যা ইকোনোমিক টাইমস

তবে দ্যা ইকোনোমিক টাইমস তাদের অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত ‘Gulf of Oman incident sparks rumours: Are ships on fire near Strait of Hormuz amid Iran-Israel escalation?’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে দাবি করে মঙ্গলবার (১৭ জুন) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ইরানের উপকূলীয় সীমান্ত ঘেঁষা ওমান উপসাগরের জলে তিনটি পৃথক স্থানে বড় আকারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি গুজব। 

ইকোনমিক টাইমস দাবি করেছে তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানে ফার্মস মানচিত্রে ওই মুহূর্তে এমন কোনো তাপচিহ্ন খুঁজে পায়নি, তবুও ছবি ও স্থানীয় রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আলোচনার ঝড় চলছে।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলোতে গভীর সমুদ্রে ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলী ও আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যায়। যদিও ছবিগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি, তবুও কিছু ব্যবহারকারী জোর দিয়েই বলেছেন—ছবিগুলো ইরানের উপকূল সংলগ্ন অঞ্চলের এবং সেগুলোর মধ্যে কমপক্ষে তিনটি তেলবাহী ট্যাংকার রয়েছে।

ইরান বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকারিভাবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। খোর ফাক্কান কন্টেইনার টার্মিনাল কিংবা আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে কোনো বিবৃতি দেয়নি। এই নীরবতা পরিস্থিতিকে আরও ধোঁয়াশাপূর্ণ করে তুলছে এবং গুজব ছড়ানোর পেছনে অবলম্বন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব অপরিসীম। পারস্য উপসাগর এবং ওমান উপসাগরের মাঝখানে অবস্থিত এই সংকীর্ণ জলপথ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১৭.৮ থেকে ২০.৮ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ও জ্বালানি বহনকারী জাহাজ চলাচল করে। এটি বিশ্বজুড়ে তেলের মোট সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে। তাই এই অঞ্চলে যে কোনো অস্থিরতা কিংবা সঙ্কট বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।

এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ঠিক সেই সময়, যখন মাত্র চার দিন আগে, ১৩ জুন, ইসরায়েল ইরানের উপর বিমান হামলা চালায়। হামলার লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র এবং শীর্ষ সামরিক কমান্ডাররা। ইসরায়েল এই হামলার পক্ষে যুক্তি দেয় যে, এটি মূলত ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে বাধা দেওয়ার একটি প্রয়াস।

অন্যদিকে, ইরান বরাবরই পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে এবং পশ্চিমা চাপের প্রতিক্রিয়ায় হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে বহুবার। ইরান দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে যে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও পশ্চিমা হস্তক্ষেপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেশটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে এবং হরমুজ প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ তাদের কৌশলগত অধিকার।

পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক বিতর্কিত মন্তব্য। মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন—ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি পারমাণবিক চুক্তির সুযোগ নষ্ট করেছে এবং জনগণকে ‘তাৎক্ষণিকভাবে তেহরান ছাড়তে’ বলেন। তার এই বক্তব্য উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে জ্বালানির ওপর ঘি ঢেলে দেওয়ার মতোই হয়েছে।

সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত উৎস জানার আগেই ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যাখ্যা মিলে যেতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ওপেন সোর্স গোয়েন্দা তথ্যসূত্র ব্যবহার করে এই ধরনের তথ্য ছড়িয়ে পড়া খুব সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি শুধু সামাজিক উদ্বেগই নয়, বরং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও জ্বালানির প্রবাহে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, যদি ওমান উপসাগরে তিনটি জাহাজে সত্যিই আগুন ধরে থাকে, তবে সেটা নিছক দুর্ঘটনা হলেও তা বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ হরমুজ প্রণালী দিয়ে দৈনিক প্রায় ১৮ থেকে ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়। এই প্রণালীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে তা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বিশ্বব্যাপী জ্বালানির বাজারে তীব্র অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো—ঘটনার প্রকৃত কারণ ও উৎস নির্ধারণ করা, বিশেষ করে যখন এটি ভূ-রাজনৈতিকভাবে অতি স্পর্শকাতর এক অঞ্চলে ঘটছে। এমন প্রেক্ষাপটে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা (যদি সত্যি হয়) এবং তাকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া গুজবকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এটি নিছক দুর্ঘটনা, কৌশলগত হামলা, না কি বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোর অপচেষ্টা—তা সময়ই বলবে। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট—ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব যত দীর্ঘ হবে, ততই হরমুজ প্রণালী ও ওমান উপসাগর ঘিরে এমন অনিশ্চয়তা বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।

সূত্র: সিবিএস নিউজ, মেরিন ইনসাইট, ইটি অনলাইন

নিউজটি আপডেট করেছেন : নিজস্ব প্রতিবেদক

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
​‘এনবিআর সংস্কার’ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর বার্তা

​‘এনবিআর সংস্কার’ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর বার্তা